কুষ্টিয়ার কুমারখালী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বায়োমেট্রিক হাজিরা মেশিন চালু হয়নি

আপডেট: September 4, 2024 |

আসাদুর রহমান, কুষ্টিয়া জেলা প্রতিনিধি: কুষ্টিয়ার কুমারখালীর ১৪৭ টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রায় ২৭ লাখ ৯৩ হাজার টাকার ১৪৭টি বায়োমেট্রিক হাজিরা মেশিন।

স্লিপের টাকায় স্থাপনের পর একদিনও ব্যবহার না হওয়ায় ধুলা, বালি জমে কত গুলো মেশিন আবার নষ্ট হয়েছে।

মেশিন কেনাকাটায়ও ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে।

অভিযোগ উঠেছে ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে কুমারখালী পৌরসভার সাবেক মেয়র ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সামছুজ্জামান অরুন তার পুত্র অর্ণব কিবরিয়া প্রতীকের কাছ থেকে ‘ রিয়েল টাইম ব্র্যান্ডের আর এস ২০ বি মডেলের বায়োমেট্রিক হাজিরা মেশিন স্থাপনের নির্দেশ দেন।

আর প্রতিটি মেশিনের বাজারমূল্য ৬ থেকে ৭ হাজার টাকা হলেও মেয়রপত্র নামসর্বস্ব ‘ প্যাসিফিক এন্টারপ্রাইজ ‘ ও ‘ টারডো কম্পিউটার ‘ নামক প্রতিষ্ঠানের ভুয়া ভাউচার ব্যবহার করে ১৯ থেকে ২০ হাজার টাকা করে বিল তুলে নিয়েছেন।

উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ২০১৮ -২০১৯ অর্থবছরে প্রাথমিক ও গণ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে স্লিপের টাকায় বায়োমেট্রিক হাজিরা মেশিন কেনার সিদ্ধান্তু হয়।

নির্দেশনা অনুযায়ী বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিজ দায়িত্বে বাজার যাচাই বাছাই করে সাশ্রয়ী মূল্যে মেশিন কিনে স্থাপন করবেন। এর কোনো ব্যত্যয় হলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থাগ্রহণ করা হবে।

তবে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা ভেস্তে দিয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক মেয়রপুত্র অর্ণব কিবরিয়া প্রতীক।

তিনি ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে জোরপূর্বক তাঁর লোকজন দিয়ে বিদ্যালয় গুলোতে ‘ রিয়েল টাইম ‘ ব্র্যান্ডের ‘ আর এস ২০ বি ‘ মডেলের বায়োমেট্রিক হাজিরা মেশিন স্থাপন করেন এবং ঢাকার তেঁজগাও পান্থপথ এলাকার ঠিকানা ব্যবহার করে ‘ প্যাসিফিক এন্টারপ্রাইজ ‘ ও কুমারখালী বাসস্টান্ড এলাকার’ টারডো কম্পিউটার ‘ নামক প্রতিষ্ঠানের ভুয়া ভাউচার ব্যবহার করে এক একটি ১৯ থেকে ২০ হাজার টাকা করে বিল তুলে নিয়েছেন।

ভাউচারের ঠিকানায় মেয়রপুত্র নিজের মোবাইল নাম্বার ব্যবহার করেছেন।

আরো জানা যায়, নির্দেশনার বাইরের ব্যক্তির দ্বারা মেশিন গুলো কেনাকাটায় ব্যাপক অনিয়ম দুর্নীতি হয়েছে। তবে মেশিন কেনার পর একদিনও ব্যবহার করা হয়নি।

দীর্ঘদিন পরে থাকায় অনেক মেশিন নষ্ট হওয়ার উপক্রম। জানতে চাইলে রিয়েল টাইম কোম্পানির হটলাইনের ‘ ০১৯৭৯২৩৪৩৪৪’ নাম্বারে এক কর্মকর্তা জানান, আর এস ২০ বি মডেলের বায়োমেট্রিক মেশিনটি আপাতত স্টকে নেই।

সেসময় প্রতিটি মেশিন ৬ হাজার ৫০০ টাকায় বিক্রি করা হতো।

কুমারখালী টারডো কম্পিউটারের স্বত্বাধিকার লিটন আব্বাস বলেন, তিনি কোনদিনও বায়োমেট্রিক হাজিরা মেশিন কেনাবেচা করেননি। তার দোকানের ভাউচার নকল করে বিল করা হয়েছে।

এদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত বলে তিনি মনে করেন। উপজেলার পৌরসভা, যদুবয়রা, জগন্নাথপুর, সদকী, পান্টি, নন্দলালপুর ও চাপড়া ইউনিয়নের প্রায় ৫৫ টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ঘুরে দেখা যায়, শিক্ষকদের কার্যালয়ে দরজার পাশের দেওয়ালে কালো রঙের বায়োমেট্রিক হাজিরা মেশিন স্থাপন করা।

তাতে ধুলো-বালি জমে মাকড়শা বাসা বেঁধেছে। অচল অবস্থায় পড়ে আছে। আর সার্ভার মেশিনটি রাখা হয়েছে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কার্যালয়ে।

তার উপরে রাখা রয়েছে কাগজপত্রাদির স্তুপ। স্লিপের টাকা বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যাচাই বাছাই করে খরচ করবেন বলে জানিয়েছেন বজরুক দুর্গাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মাহবুবুল আলম।

তিনি বলেন, ‘আমি বাজার যাচাই করে হাজিরা মেশিন কিনতে চেয়েছিলাম। কিন্ত মেয়র ফোন দিয়ে বলেন, তার ছেলের কাছ থেকে নিতে।

তার ভাষ্য, মেয়রপুত্র লোক পাঠিয়ে মেশিন লাগিয়ে ১৯ হাজার টাকা নিয়ে গেছে। যদিও মেশিনটি ১০ থেকে ১২ হাজার টাকায় কেনা যেত।

বানিয়াকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক (ভারপ্রাপ্ত) শাহানারা পারভীন বলেন, ১৯ হাজার টাকা নিয়ে মেশিন লাগিয়ে গেছে। একদিনও চলেনি, নষ্ট।

অভেদানন্দ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নাছরিন আক্তার বলেন, সহকারী দ্বিপেন্দ্রনাথ পালের মাধ্যমে টারবো কম্পিউটার থেকে মেশিনটি আমরাই কিনেছি। তবে লাগিয়েছিল মেয়রের লোকজন।

আর সহকারী শিক্ষক দ্বিপেন্দ্রনাথ পাল বলেন, স্লিপের টাকায় ২০ হাজার টাকায় মেশিন কেনা। তবে সাপ্লাই দিয়েছিল মেয়রপত্র প্রতীক।

মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ২০১৮ – ১৯ অর্থবছরে ১৪৭ টি বিদ্যালয়ে বায়োমেট্রিক হাজিরা মেশিন কেনা হয়েছে বলে জানিয়েছেন উপজেলা সহকারী প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা খন্দকার শরিফুল ইসলাম।

তিনি জানান, স্লিপের টাকা সাধারণ প্রধান শিক্ষকসহ বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বাজার যাচাই করে খরচ করার কথা। কিন্তু সেসময় কিছুটা ব্যত্যয় ঘটেছিল।

মূলত শিক্ষক-কর্মকর্তারা রাজনৈতিক পেসারে মেয়র পুত্র ও আওয়ামী লীগ নেতার ছেলে প্রতীকের পেসারে পরে মেশিন গুলো ক্রয় করে। যাচাই বাছাইয়ের সুযোগ পাইনি। এতে কিছুটা অনিয়ম – দুর্নীতি হয়েছে।

কুমারখালীতে যোগদানের পূর্বেই মেশিন গুলো স্থাপন করা হয় বলে জানিয়েছেন উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, মেশিন গুলো কোনোদিনও ব্যবহার হয়নি।

অকেজো হয়ে পড়ে আছে। তবে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা পেলে তা সচল করা হবে।

এদিকে আওয়ামী লীগ সরকার পদত্যাগের পর থেকে এলাকা ছেড়ে পালিয়েছেন প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক মেয়র সামছুজ্জামান অরুন। তার ফোনটিও বন্ধ রয়েছে। সেজন্য বক্তব্য পাওয়া যায়নি

Share Now

এই বিভাগের আরও খবর