একজন গার্মেন্টস কর্মীর জাপান যাত্রা
মোহাম্মদ রেজাউল করিম, চট্টগ্রাম প্রতিনিধিঃ জীবনে কখনো ভাবেননি যে, তিনি একদিন জাপান যাবেন কিন্তু ভাগ্য যে তার প্রতি সুপ্রসন্ন হয়ে আছে সেটি তিনি জানতেন না।
তিনি অন্য দশ জনের মতো অজপাড়া গায়ের সাধারণ একজন মানুষ। যার কথা বলছিলাম তিনি পটুয়াখালী বাউফলের ছেলে নাম তাঁর ইকবাল।
এক যুগেরও বেশি সময় ধরে তিনি চট্টগ্রামের চাঁন্দগাও থানাধীন বিসিক শিল্প এলাকায় স্ত্রী সন্তান নিয়ে বসবাস করে আসছিলেন।
চাকরি করতেন ঐ এলাকার এক পোশাক শিল্পের কারখানায়। তাঁর কাজ ছিল রান্না বান্না করা। আমার সাথে তাঁর পরিচয় ঐ পোশাক শিল্পের কারখানায়।
আমিও এক সময় সেখানে চাকরি করেছি মানব সম্পদ বিভাগে। যার ফলে তাঁর সম্পর্কে আমার ধারণা আগে থেকেই। সে ভালো রান্না করতে পারে এ কথা বহুবার শুনেছি অনেকের মুখে।
একদিন জাপান প্রবাসী আমার এক বন্ধু মন্জুরুল ইসলাম আমাকে ফোন করে জানালেন যে, তাঁর রেস্টুরেন্টের জন্য একজন ভালো বাবুর্চি প্রয়োজন।
যে ভাবেই হোক আমাকে ব্যবস্থা করে দিতে হবে। চিন্তায় পড়ে গেলাম, কোথায় পাই একজন ভালো বাবুর্চি! এ কথা আমার অন্য একজন সহকর্মীকে জানালে সে ইকবালের নাম প্রস্তাব করে। আমি বললাম বেশ ভালো।
ইকবালকে ডেকে আমার অফিস রুমে আনা হলো। তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম ইকবাল তুমি কি কাজের ভিসা নিয়ে জাপান যেতে ইচ্ছুক? সে জানালো জি স্যার, কিন্তু আমার কাছে তেমন টাকা পয়সা নেই স্যার।
তাঁর এই কথা গুলো আমি ভিডিও ধারণ করে জাপানে আমার বন্ধু মন্জুরুল ইসলামকে পাঠিয়ে দিলাম। মন্জুর ভাই ভিডিও বার্তা দেখে আমাকে জানালেন যে, “ইকবালের কথা গুলো আমার ভালো লেগেছে তাকে আমি জাপানে আনতে চাই”।
শুরু হলো প্রক্রিয়া, সে কি! ইকবালের ভোটার আইডিতে সমস্যা, তাঁর আইডিতে আরো একজনের নাম দেখা যাচ্ছে নির্বাচন কমিশনের সার্ভারে। কি করা যায় এখন! চিন্তায় পড়ে গেলাম আমি আর ঐ দিকে জাপানে মন্জুর ভাই।
শুরু হয়ে গেল আমাদের অভিযান। এই কাজ কি আর অত সহজ? যাই হোক ইকবাল তো এই দেশের ই একজন নাগরিক।
অবশেষে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক নির্বাচন কমিশনের কার্যালয় থেকে ঢাকার প্রধান কার্যালয়ে বার্তা প্রেরণ করে অনেক ঝক্কি ঝামেলা পোহানোর পর ইকবালের জাতীয় পরিচয়পত্র এন আই ডি সংশোধন হলো, সাথে পেল স্মার্ট এন আই ডি কার্ড ও।
এর পর এলো পাসপোর্ট এর পালা, যাক যেহেতু এন আই ডি আছে তাই পাসপোর্ট বানাতে ও সামান্য ঝামেলা পোহানোর পরে ইকবাল পেয়ে গেল পাসপোর্ট।
এ যাত্রায় ইকবালের কাজ শেষ, শুরু হলো জাপানে মন্জুর ভাইয়ের ইকবালের জন্য ভিসা প্রসেসিং এর কাজ। তাও সময় লেগেছে মাস দুই এক।
যাক পাওয়া গেল জাপান সরকারের অনুমোদনকৃত ইকবালের নামে ইস্যু হওয়া Skilled Labour ভিসা। স্পেশাল কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে ভিসা পাঠানো হলো বাংলাদেশে। সাথে এম্বাসী এপয়েন্টমেন্ট।
নির্দিষ্ট তারিখে সকল কাগজপত্র নিয়ে ইকবাল চলে গেল ঢাকায় জাপান দূতাবাসে। ইন্টারভিউতে টিকে গেল ইকবাল তাঁর কাগজ পত্র জমা নিল দূতাবাসে।
এবার দূতাবাস থেকে তাঁকে একটি স্লিপ দেয়া হলো যা পরবর্তী তারিখ তাকে ফোন করে জানিয়ে দেয়া হবে তাঁর পাসপোর্ট ডেলিভারি আনার জন্য। অবশেষে ফোন এলো দূতাবাস থেকে যে তাঁর ভিসা ইস্যু হয়েছে।
ইকবালের সে যে কি আনন্দ। আহা আমি তার আনন্দের কথা গুলো গুছিয়ে লিখতে পারছিনা। “স্যার আমার ভিসা হইছে জাপান এম্বাসী থেকে আমাকে ফোন করছে”। যাক তাঁর এই খুশির অংশীদার আমিও।
আজ ইকবাল চলে যাচ্ছে জাপান। মঙ্গলবার (১১জুন) রাত ১১:৪৫ এর সময় বাংলাদেশ বিমানের BG-376 এর একটি ফ্লাইটে করে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হতে জাপানের উদ্দেশ্য বাংলাদেশ ছেড়ে গেল এ দেশের আরো একজন নতুন রেমিটেন্স যোদ্ধা।
জীবনে কখনো কল্পনা ও করেননি যে, তিনি একদিন জাপান পাড়ি দেবে। প্লেনের সিটে বসে তিনি আমাকে কয়েকটি ছবি তুলে পাঠালো।
তাঁর পাঠানো ছবি গুলোর মধ্যে একটি ছবি আমার হৃদয় আন্দোলিত করেছে। যার কারণে আমার এই লেখা। তাকে জাপানে পাঠানোর জন্য বিভিন্ন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে গিয়ে আমার নিজেরও অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে।
আমিও প্রবাসে ছিলাম বহু বছর। প্রবাসে থাকা কালীন আমি অনক ভালো মনের উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন বিদেশি মানুষের সংস্পর্শে ছিলাম। দেখেছি তাদের মহানুভবতা, নিঃস্বার্থ পরোপকারীতা।
যা আমাদের দেশে অসম্ভব এবং আকাশকুসুম কল্পনা। মূলত নিঃস্বার্থ পরোপকার যেন এ দেশের মানুষের মনে জাগ্রত হয় সেটাও এই লেখার মাধ্যমে আমার একটি ক্ষুদ্র বার্তা।
ইকবালের জাপান যাত্রার আনন্দ শুধু তাঁর একার নয়, এই আনন্দের অংশীদার আমি, আপনি এবং আমরা সবাই যারা ইকবালের বিদেশ যাত্রায় ঘুষ বিহীন নিঃস্বার্থ ভাবে তাকে সাহায্য করেছে দেশের কল্যাণে।
এই ইকবালদের কারণে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে একদিন।