জামালপুরে আওয়ামী লীগের ১৬ বছরের সাম্রাজ্য বিএনপির দখলে

আপডেট: September 3, 2024 |

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে ১৬ বছরের ক্ষমতায় থাকা শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর জামালপুরে আওয়ামী লীগের দখলে থাকা বাসস্ট্যান্ড, সিএনজিস্ট্যান্ড, বাজার, বালুমহালসহ বিভিন্ন স্থাপনা একে একে দখলে নিচ্ছেন বিএনপির নেতা-কর্মীরা।

বালুমহাল ও পরিবহন খাত থেকে ওঠানো চাঁদার টাকা আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতা-কর্মীদের মধ্যে ভাগাভাগি করতে সমঝোতার চেষ্টার খবরও পাওয়া যাচ্ছে। বিএনপি দখল, চাঁদাবাজি, লুটপাট থেকে বিরত থাকতে নেতা-কর্মীদের কঠোর নির্দেশনা দিলেও তা কাজে আসছে না।

৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের পর সদরসহ জেলার সাতটি উপজেলায় বিএনপির নেতা-কর্মীরা আওয়ামী লীগের লোকজনের বাড়িঘর ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা-ভাঙচুর চালান।

সবচেয়ে বেশি ঘটনা ঘটে সদরে। এর মধ্যে বালুমহাল দখলে নিতে বিএনপির দুই পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনাও ঘটে।

টানা ১৬ বছর জামালপুর শহরের ছনকান্দা থেকে পিয়ারপুর এলাকা পর্যন্ত ব্রহ্মপুত্র নদের প্রায় ২৫ কিলোমিটার এলাকায় অর্ধশত স্থান থেকে দিন-রাত বেপরোয়া বালু তুলেছেন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। ইজারার নামে রাস্তায় ট্রাকপ্রতি ২০০ থেকে ৪০০ টাকা করে চাঁদা নিতেন। এখন সেই বালুর ব্যবসা নিজেদের কবজায় নিয়েছেন বিএনপির নেতা-কর্মীরা।

গত ১৮ আগস্ট শরিফপুর ইউনিয়নের জয়রামপুর এলাকার একটি বালুমহাল দখলে নিতে ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি মিজানুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলামের সঙ্গে জেলা যুবদলের সদস্যসচিব মো. সুহেলের অনুসারীদের মধ্যে ধাওয়া পাল্টাধাওয়া হয়। এ সময় সুহেলের অনুসারী শরিফপুর ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক আহ্বায়ক রেজাউল করিমের ঘরবাড়ি ভাঙচুর করা হয়।

রেজাউল করিম মুঠোফোনে বলেন, ‘বালুর ঘাটগুলো এখন জেলা বিএনপির নেতাদের নিয়ন্ত্রণে। ঘাটে যাওয়ার সময় আমার ঘরবাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে।’ তবে অভিযোগ অস্বীকার করে ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি মিজানুর রহমান বলেন, ‘ওই দিন আমার লোকজনের সঙ্গে কোনো ঘটনা ঘটেনি। বালুমহালের ইজারাদার অসীম এন্টারপ্রাইজের লোকজনের সঙ্গে কিছু একটা হয়েছিল। আমি সেটা জানি না। বালুমহালে আমাদের কেউ যাননি।’

স্থানীয় সূত্র জানায়, বাংলা নতুন বছরের প্রথম দিকে সদর উপজেলার ছনকান্দা, চরযথার্থপুর, শরিফপুর, নান্দিনা, নরুন্দি, পিয়ারপুরসহ ছয়টি এলাকার দুটি বালুমহাল ইজারা দেয় জেলা প্রশাসন। তখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকায় প্রভাব খাটিয়ে এসব ঘাটের ইজারা নেন দলটির স্থানীয় নেতা-কর্মী ও সমর্থকেরা। সরকার পতনের পর এসব ঘাটের নিয়ন্ত্রণ নেন বিএনপির নেতা-কর্মী ও অনুসারীরা।

মেসার্স হাজী এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী ও জামালপুর পৌর আওয়ামী লীগের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সভাপতি (ভারপ্রাপ্ত) হাজী বাহার উদ্দিন বলেন, ‘আমি বৈধভাবে বালুমহাল ইজারা নিয়েছি। কিন্তু ৫ আগস্টের পর ইজারা আদায় বন্ধ। বিএনপির নেতারা সব ভাঙচুর করেছেন। তারা এখন ইজারা আদায়ের ৪০ শতাংশ চাচ্ছেন। ব্যবসা করতে হলে তো তাদের সঙ্গে সমঝোতা করতেই হবে। এখন কিছুই করার নেই।’

১৬ বছর ধরে শহরের কেন্দ্রীয় বাসস্ট্যান্ডের নিয়ন্ত্রণ ছিল আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের হাতে। ৫ আগস্টের পর সেটি বিএনপির লোকজন নিয়ন্ত্রণে নেন। গাড়ির মালিকদের বেশির ভাগই আওয়ামী লীগের নেতা ও এর অনুসারী। সরকার পতনের পর তাদের অধিকাংশই আত্মগোপনে আছেন। এ সুযোগে আওয়ামী লীগের সময়ের জেলা বাস মালিক সমিতির কমিটি বাদ দিয়ে ২২ আগস্ট জেলা বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সমন্বয়ে নতুন জেলা বাস মালিক সমিতির কমিটি গঠন করা হয়েছে। নতুন কমিটিতে জামালপুর পৌর বিএনপির ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত হোসেনকে (শুভ) সাধারণ সম্পাদক ও জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সদস্য রফিকুল ইসলামকে (জার্নিস) সভাপতি করা হয়েছে।

বাসস্ট্যান্ড–সংশ্লিষ্টরা জানান, সাখাওয়াতের কোনো গাড়ি নেই। তারপরও তিনি মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন। কমিটিতে যারা অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। তাদের বেশির ভাগেরই গাড়ির ব্যবসা নেই। শুধু বিএনপি করায় তারা কমিটিতে আছেন।

সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘আগের মতো বাসস্ট্যান্ডে কোনো চাঁদা আদায় করা হয় না। সবকিছু এখন উন্মুক্ত করা হয়েছে। ৫৬ জন মালিক ও শ্রমিকের কণ্ঠভোটে আমাকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছে।’ গাড়ির মালিক না হওয়া প্রসঙ্গে বলেন, ‘গাড়ি না থাকলে কি আর আমাকে সাধারণ সম্পাদক করেছে? আমার গাড়ি আছে।’

জামালপুর পৌর বাসস্ট্যান্ডের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন জেলা শ্রমিক দলের সাংগঠনিক সম্পাদক সাদিকুর রহমান। গত শনিবার ‍দুপুরে বাসস্ট্যান্ড প্রাঙ্গণে সাদিকুরকে লোকজন নিয়ে বসে থাকতে দেখা যায়। সাদিকুর রহমান বলেন, ‘আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা পলাতক। এ জন্য আমরা এসে বাসস্ট্যান্ডটি পরিচালনা করছি। এখন কোনো চাঁদা নেয়া হয় না।’

বকশীগঞ্জ উপজেলা বাসস্ট্যান্ডেরও নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন উপজেলা বিএনপির সাবেক সদস্যসচিব আব্দুল কাইয়ুম, উপজেলা শ্রমিক দলের সভাপতি মো. শাহিনুজ্জামান ও সাধারণ সম্পাদক মো. মনিরুজ্জামান। শাহিনুজ্জামান দাবি করেন, ‘আওয়ামী লীগের নেতারা পালিয়ে যাওয়ার পর থেকে শ্রমিকেরাই বাসস্ট্যান্ড চালাচ্ছেন। সেখানে আমরা যাইনি বা কোনো চাঁদাও নেয়া হয় না।’

মাদারগঞ্জ পৌর বাসস্ট্যান্ড এখন উপজেলা শ্রমিক দলের সভাপতি মো. আনোয়ার জাহিদের নিয়ন্ত্রণে। জানতে চাইলে আনোয়ার জাহিদ বলেন, ‘বাসস্ট্যান্ডে অনেক গ্রুপ ঝামেলার চেষ্টা করেছিল। আমি সেটা নিয়ন্ত্রণ করি। বর্তমানে বাসস্ট্যান্ড পরিচালনা করছেন শ্রমিক ও ড্রাইভাররা।’ তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে উপজেলা আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, বাসস্ট্যান্ড এখন বিএনপির নেতারা দখলে নিয়েছেন।

সার্বিক বিষয়ে জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক শাহ্ মো. ওয়ারেছ আলী মামুন বলেন, দীর্ঘদিন সব জায়গা আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের একক নিয়ন্ত্রণে ছিল। তারা পালিয়ে যাওয়ায় জায়গাগুলো খালি হয়ে যায়। সেখানে হয়তো স্থানীয় নেতা-কর্মীরা গিয়ে থাকতে পারেন, তবে সেটিকে দখল বলা যাবে না। ৫ আগস্টের পর জেলার বাসস্ট্যান্ড, সিএনজিস্ট্যান্ডসহ অনেক জায়গায় অচল অবস্থা তৈরি হয়েছিল। বিএনপির স্থানীয় নেতা-কর্মীরা সেগুলো সচল করার ব্যবস্থা করেছেন। বাসস্ট্যান্ডের মালিক সমিতির কমিটির বিষয়ে বলেন, স্বাভাবিক রাখতে বাসমালিকেরাই ওই কমিটি গঠন করেছে।

ওয়ারেছ আলী মামুন বলেন, ‘আমি প্রতিটি সভায় নেতা-কর্মীদের বলে দিয়েছি, কোথাও দখল, চাঁদাবাজি ও বিশৃঙ্খলা করা যাবে না। যারা করবেন, তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে। এরপরও কোথাও কিছু করলে খোঁজখবর নিয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

সূত্র: প্রথম আলো

Share Now

এই বিভাগের আরও খবর