ঢাকার থানায় ফেরেনি পুলিশ, রাত হলেই আতঙ্ক

আপডেট: August 9, 2024 |

পুলিশ সদস্যদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে স্ব-স্ব কর্মস্থলে যোগদানের নির্দেশ দেয়া হলেও থানাতে ফেরেনি পুলিশ। থানার নিরাপত্তায় রয়েছেন আনসার সদস্যরা, পাশাপাশি অনেক জায়গায় স্থানীয়দেরও থানা পাহারা দিতে দেখা গেছে। পরিস্থিতি নিয়ে ডিএমপির কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন নবনিযুক্ত ডিএমপি কমিশনার মো. মাইনুল হাসান।

এদিকে পুলিশের কার্যক্রম না থাকায় শহরজুড়ে নাগরিকদের নিরাপত্তাহীনতা আর উদ্বেগ জেঁকে বসেছে। রাত হলেই ঢাকার অলি-গলিতে সৃষ্টি হচ্ছে ডাকাত আতঙ্ক। দল বেঁধে পাড়া-মহল্লায় পাহারা দিচ্ছেন স্থানীয়রা।

শেখ হাসিনার দেশ ছাড়ার পর থেকেই দেশজুড়ে থানাসহ পুলিশের স্থাপনাগুলোতে একের পর এক হামলা হতে থাকে। নির্বিচারে আক্রমণ হতে থাকে থানায়, ভাঙচুর ও লুটপাটও করা হয় অনেক থানায়।

এসব ঘটনায় নিহত হয়েছেন অনেক পুলিশ সদস্য ও নন-ক্যাডার কর্মকর্তা। এর পরবর্তী তিন দিন নিরাপত্তাহীনতা ও সহকর্মীদের হতাহত হওয়ার ক্ষোভ থেকে কাজে যোগ দেননি পুলিশ সদস্যরা। যার ফলে ঢাকার থানাগুলো এখনও পুলিশশূন্য। আইনশৃঙ্খলা ও ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে কোথাও কাজ করছে না ঢাকার পুলিশ।

থানার নিরাপত্তার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে আনসার সদস্যদের। ঢাকার ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছে শিক্ষার্থীরা। তাদের সঙ্গে কাজ করছেন আনসার ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরাও।

বুধবার পুলিশের আইজি হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পরই মো. ময়নুল ইসলাম বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে পুলিশ সদস্যদের কর্মস্থলে যোগ দিতে নির্দেশ দেন। তবে বৃহস্পতিবার বিকাল থেকে ঢাকার পাঁচটি থানা ঘুরে পুলিশের কোনো কার্যক্রম দেখা যায়নি।

সন্ধ্যায় তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় গিয়ে দেখা যায়, কয়েকজন আনসার সদস্য থানার প্রধান ফটকে তালা মেরে ভেতরে দাঁড়িয়ে আছেন। থানা প্রাঙ্গণে পোড়া গাড়ির স্তুপ। ভেতরটা পুরো তছনছ। আনসার সদস্য শহীদউল্লাহ বললেন, “কিছুক্ষণ আগে ওসি স্যার আসছিলেন। কিছুক্ষণ দেখে-ঠেকে চলে গেছেন।”

এর আগে বিকালে শেরেবাংলা নগর থানায় গিয়ে দেখা যায়, থানার ফটকে তালা মেরে ভেতরে আনসার সদস্যরা দাঁড়িয়ে আছেন। তারা বললেন, থানায় কোনো পুলিশ সদস্য আসেননি। থানার বাইরে স্থানীয় মসজিদের ইমামের নেতৃত্বে ১৫-২০ জন মাদ্রাসাছাত্র থানা পাহারা দিচ্ছেন।

দুপুরে মোহাম্মদপুর থানায় গিয়ে দেখা যায়, পোড়া থানা থেকে ধোঁয়া উঠছে, কটূ গন্ধ চারদিকে। থানা প্রাঙ্গণে পোড়া গাড়ির স্তূপ।

মোহাম্মদপুর থানায় দায়িত্বরত আনসার সদস্য শহীদুল ইসলাম দুপুর ১টার দিকে বলেন, দুপুর ১২টার দিকে সাদা পোশাকের একজন পুলিশ পরিদর্শক এসে ভেতরটা পরিদর্শন করে চলে যান। এর বাইরে থানার কোনো সদস্য আসেননি।

ঢাকায় পুলিশি কার্যক্রম ফেরাতে বিভিন্ন অপরাধ বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) ও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের (ওসি) সঙ্গে বৈঠক করেছেন নবনিযুক্ত ডিএমপি কমিশনার মো. মাইনুল হাসান।

দুপুরের পর হওয়া বৈঠকে কর্মকর্তারা সবাই যোগ দেন সাদা পোশাকে। কর্মকর্তাদের কাউকেই তাদের সরকারি গাড়ি ব্যবহার করতে দেখা যায়নি। ব্যক্তিগত গাড়ি, সিএনজি অটোরিকশা, মোটরসাইকেলের মত যানবাহন ব্যবহার করে তারা ডিএমপি সদর দপ্তরে আসেন।

বৈঠকে উপস্থিত ডিএমপির লালবাগ বিভাগের উপকমিশনার মাহবুব-উজ-জামান বলেন, পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে তাদের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে বৈঠক হয়েছে।

“বৈঠকে কাজে ফেরার তাগিদ দেয়া হয়। যত দ্রুত সম্ভব কাজে ফিরব। থানাগুলোর যে বেহাল অবস্থা, সেগুলো তো রাতারাতি ঠিক করা যাবে না। শুরু করতে হবে, শুরু না করলে তো শুরু হবে না।”

থানা থেকে লুট হওয়া অস্ত্র সরকারের পক্ষ থেকে ফিরে দেয়ার ঘোষণা না এলে আতঙ্ক কাটবে না বলে মনে করেন এই পুলিশ কর্মকর্তা।

থানায় পুলিশের কার্যক্রম শুরুর বিষয়ে নতুন আইজিপি ময়নুল ইসলাম বৃহস্পতিবার বলেন, “সহসাই থানার কার্যক্রম শুরু হবে। অনেক থানা-ই কাজ শুরু করছে বা করতে যাচ্ছে।

বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার মধ্যে কাজে যোগ দিতে নির্দেশ দেয়া হলেও ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া ঢাকার থানাগুলোতে বা অন্যান্য স্থানে কোনো পুলিশ সদস্যকে দেখা যায়নি।

এ বিষয়ে আইজিপি বলেন, “কেউ যোগ দেননি এটাও যেমন বলা যাবে না, সবাই এখন এসেছে এটাও ঠিক না।”

সেনাবাহিনীর সহায়তা নিয়ে পুলিশ বাহিনী পূর্ণগঠনে কাজ চলছে বলে তথ্য দিয়েছেন ময়নুল ইসলাম।

এদিকে রাত হলেই ঢাকায় নামছে ডাকাত আতঙ্ক। মঙ্গলবার রাতে ঢাকার মোহাম্মদপুর, মিরপুর, উত্তরাসহ বিভিন্ন এলাকায় ডাকাত আতঙ্ক দেখা দেয়। বুধবার ঢাকার উত্তর থেকে দক্ষিণ প্রান্ত, উত্তরা থেকে মোহাম্মদপুর পর্যন্ত ছড়ায় এই আতঙ্ক।

ফেইসবুকের বিভিন্ন গ্রুপে পোস্ট লিখে, লাইভ করে নিজেদের নিরাপত্তা চেয়েছেন অনেক আতঙ্কিত বাসিন্দা। আবার মোহাম্মদপুর, উত্তরার অনেক এলাকাতেই দল বেঁধে রাতে পাহারা দিয়েছেন এলাকাবাসী।

সেনানিবাসসংলগ্ন ইসিবি চত্বরসহ বিভিন্ন এলাকায় কয়েকজনকে সেনাবাহিনী আটক করেছে বলেও খবর ছড়িয়েছে। তবে তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

মোহাম্মদপুরের বসিলার বাসিন্দা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খণ্ডকালীন শিক্ষক নাজভী ইসলাম জানাচ্ছেন, মঙ্গলবার রাতেও তাদের এলাকায় ডাকাত আতঙ্ক ছড়িয়েছিল। মসজিদের মাইকে বারবার ঘোষণা দিয়ে সবাইকে সজাগ থাকতে বলা হয়।

ওই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বুধবার রাতে এলাকাবাসী দল বেঁধে লাঠি-সোঁটা হাতে রাস্তায় পাহারা দিতে নেমে যান তারা। তাদের সঙ্গে স্থানীয় মাদ্রাসার শখানেক ছাত্রও যোগ দেন। রাতভর পাহারা দিয়ে ভোরে তারা ঘরে ফিরে যান।

ডাকাতের আতঙ্ক ছড়িয়েছে ধানমন্ডি, শংকর ও মিরপুর এলাকতেও। এদিকে, রাত ৩টার দিকে নিজের ভেরিফায়েড ফেইসবুক একাইন্ট থেকে লাইভে এসে সাহায্য চান অভিনেত্রী রুকাইয়া জাহান চমক। উত্তরার প্রিয়াংকা রানওয়ে সিটিতে ডাকাতরা হামলা করেছে জানিয়ে তিনি সাহায্য চাইছিলেন।

তিনি বলেন, ভবনের বাসিন্দারা যার হাতে যা আছে দা-বটি-লাঠি, তাই নিয়ে নিচে নেমেছেন ডাকাত মোকাবেলা করতে। তারা সেনাবাহিনীকে কল করেও পাচ্ছেন না। তিনি সেনাবাহিনীর টহল দলকে সেখানে যাওয়ার জন্য বারবার অনুরোধ করেন।

মিরপুর সেনানিবাসসংলগ্ন ইসিবি চত্বরে ডাকাতরা একটি ভবনে হামলা করেছে বলে অনেকে ফেইসবুকে লাইভ করতে থাকেন। ভিডিওগুলোতে শুধু হই চই আর সেনা টহলগাড়ির সাইরেনের শব্দ শোনা যাচ্ছিল। সেখান থেকে সেনাবাহিনী কয়েকজনকে আটক করেছে বলে ফেইসবুকে খবর ছড়ালেও তা নিশ্চিত করা যায়নি।

ডাকাতরা হামলা করেছে বা আসছে- রাতভর ফেইসবুকে ডাকাত নিয়ে পোস্ট দিয়েছেন অনেকে। আবার একযোগে ঢাকা শহরে এত ডাকাত কোথা থেকে এল, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে।

এটা নিছক আতঙ্ক কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। আবার মোহাম্মদপুরে এলাকা পাহারা দিতে বের হওয়া দুটি পৃথক দল পরস্পরকে ডাকাত ভেবেও হইচই করেছে বলে মাসুম সারোয়ার নামে একজন ব্যাংক কর্মকর্তা তথ্য দিয়েছেন।

Share Now

এই বিভাগের আরও খবর